জাতিসংঘ প্রণীত এমডিজি (Millennium Development Goal) শীর্ষক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বাল্যবিবাহ রোধে এখনও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বিবিধ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত প্রতিবেদন আমলে নেওয়া যাক। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপির হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশে প্রতিবছর ১৭ শতাংশ মেয়ে অপরিণত বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। ইউএনএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে রোধের ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। এ দেশে ১৫ বছর বয়স পার হতে না হতেই মেয়েরা গর্ভধারণ করে। কম বয়সে বিয়ে হওয়ায় এবং গর্ভধারণ করায় এইসব কিশোরীর বেশির ভাগই নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় গর্ভকালীন জটিলতায় অনেক বালিকা বধূ অকালে মৃত্যুর শিকার হয়। প্রতিবছর এই মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ হাজার। প্রতিবারের মতো দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন-২০১৩ শীর্ষক রিপোর্ট সারাবিশ্বে একাযোগে প্রকাশ করেছে ইউএনএফপি।
জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করলেও বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই ইস্যুটি নিয়ে বাঙালি রেঁনেসার অগ্রপথিক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই ঊনিশ শতকে সোচ্চার হয়েছিলেন। তারপর নানা ঘাটে অনেক পানি গড়িয়েছে। অনেক সামাজিক বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ যে তেমন হয়নি তার প্রমাণ একুশ শতকে এসেও আমাদের শুনতে হচ্ছে বিভিন্ন অশনি বার্তা। প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজার মেয়ে অপরিণত বয়সে বিয়ে বসতে বাধ্য হচ্ছে, এটিও তার মধ্যে একটি বার্তা। এর কারণ যে অর্থনৈতিক সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কন্যাদায়গ্রস্ত বাঙালি পরিবার মাত্রেই কন্যা মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে বরাবরই অনুদার। কন্যাসন্তানকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি। সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি সর্বত্রই পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। আর সেই অযৌক্তিক আধিপত্যের অসহায় বলি হচ্ছে অনূঢ়া বালিকারা। আমাদের সমাজকে যুক্তি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল সেটা এখানে কখনও গড়ে ওঠেনি। নবজাগৃতির আলোয় সামান্য কিছুটা সংস্কার কোনো কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে হলেও সামগ্রিক বিচারে নারীসমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার অনুকূলে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখানে আজও হয়নি। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন উচ্চ শিক্ষিত সমাজের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সার্বজনীন শিক্ষা আন্দোলনে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে এখানকার সুবিধাবাদী বিদ্বান সমাজ আগ্রহ দেখায়নি। শিক্ষার আলো যারা পেয়েছেন তারা সবাই সে আলো গোটা সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখেননি। ফলে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের অচলায়তনে বন্দি থেকে গেছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। আর যারা পিছনে পড়ে থাকে তারা দেশ ও জাতির সন্মুখ যাত্রাকে যে বাধাগ্রস্ত করবে সেটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার অভাবে, জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাবে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সামাজিক ও সার্বিক অগ্রগতির পথে আজ প্রবল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে চলেছে। আজ আমাদের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণজনিত সমস্যা। এই সমস্যাটির পিছনেও বাল্যবিবাহ অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে। আমাদের জনস্বাস্থ্য আমাদের বেকারত্ব, আমাদের খাদ্য, পুষ্টি ও বাসস্থান, আমাদের শিক্ষা ও অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে বাল্যবিবাহ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর প্রভাব রেখে চলেছে। এসব মূল সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য সমাজে যে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা থাকা দরকার তারও মারাত্মক অভাব জিইয়ে রেখেছে সাংঘর্ষিক রাজনীতি। যার অবসান আজ সময়ের দাবি।
এবার আসি আইন অংশে। বাল্যবিবাহ রোধে আইনের প্রভাব কতখানি আছে? উত্তরে সবাই বলবে, শতভাগ। বাল্যবিবাহ রোধে সংস্কার এবং আধুনিক চাহিদা মোতাবেক সংশোধনী সহ খুব সম্প্রতি আইন অনুমোদিত হয়েছে। তবে বরাবরের মতই ছাপার অক্ষরে শাস্তি এবং উপায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মাঠে তার প্রয়োগ কতটুকু হবে, বা আদৌ হবে কিনা- তা নিয়ে চিরন্তন সন্দেহ রয়েই যায়। সুতরাং, হাতে হাত রেখে জোর প্রয়াসে কাজ করার সময় এসেছে। নিম্নস্তরে আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে উচ্চস্তরে আইনের কর্তাগণ- সবার সম্মিলনে বাল্যবিবাহ প্রতিহত হবে, এ আশা মনের কোণে।
Discussion about this post