শাস্তির প্রকারভেদ
মানব জীবন ও সমাজ ব্যাবস্থায় শাস্তি একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। নিচে শাস্তির প্রকারভেদ ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো । আমরা হরহামেশাই এই শব্দটি ব্যাবহার করে থাকি। কিন্তু শুধু বর্তমান সময়েই নয় অতিপ্রাচীন কাল থেকেই এই শাস্তি শব্দটি অহরহ ব্যাবহার হয়ে আসছে। প্রত্যেক সমাজ ও রাস্ট্র ব্যাবস্থার সাথে এই শব্দটি অঙ্গপ্রতঙ্গ ভাবে জড়িত। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কাজে ও বিভিন্ন ভাবে আমরা এই শব্দটি ব্যাবহার করি। কিন্তু শাস্তি শব্দের অর্থ কি বা শাস্তি বলতে আমরা কি বুঝি?
শাস্তি বলতে কি বুঝি
সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে শাস্তি বলতে আমরা দন্ডকেই বুঝি। রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করে বা
দেশে যে আইন প্রচলিত আছে তা ভঙ্গ করা অপরাধ আর অপরাধের বিনিময়ই হলো শাস্তি। অপরাধ বিজ্ঞানী গারল্যান্ড এর মতে, “শাস্তি হলো এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ফৌজদারী আইন (criminal law) ভঙ্গকারীরা নির্দিষ্ট আইনি ধারা ও পদ্ধতির মাধ্যমে দন্ডিত হয়”।
ফৌজদারী আইন নিয়ে বিস্তারিত জানুন
অন্যভাষায় আমরা শাস্তিকে ক্লেশ বলতে পারি। ইহা ব্যাক্তিগত বা সম্পত্তিগত হতে পারে। রাষ্ট্রের কোন নাগরিক বা রাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্য কোন ব্যাক্তিদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রের কোন আইন ভঙ্গ করেন তারাই এই ক্লেশ ভোগ করতে বাধ্য হবেন।
শাস্তিকে কে আমরা প্রতিশোধ বা প্রায়শ্চিত্তও বলতে পারি। কারন কোন আসামীর ফাসি হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তি এই আশ্বাস লাভ করেন যে, শাস্তির মাধ্যমে অপরাধের (যে অপরাধের ফলে সে ক্ষতিগ্রস্ত) প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। অপরদিকে আমরা জানি যে, যার মাধ্যমে বা যে কাজের মাধ্যমে পাপ ক্ষয় হয় তাকে প্রায়শ্চিত্ত বলে এবং রাষ্ট্র অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে তাকে তার পাপ ক্ষয় করতে সাহায্য করে বলে শাস্তিকে আমরা প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারি।
সমস্ত পৃথিবীতে অনেক ধরনের শাস্তির বিধান থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় ৬ ধরনের শাস্তির বিধান আছে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৫৩ ধারায় শাস্তি বা দন্ড কি কি ধরনের হবে তা বিবৃত করা আছে। যেমন-
- মৃত্যুদন্ড (ফাসি),
- যাবজ্জীবন কারাদন্ড,
- সশ্রম কারাদন্ড,
- বিনাশ্রম কারাদন্ড,
- সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরন,
- অর্থদন্ড (জরিমানা),
এইসব শাস্তির বাহিরেও কয়েক ধরনের শাস্তির প্রচলন আছে। যেমন-
- অক্ষমতা ঘোষণা,
- দেউলিয়া ঘোষণা,
- চালকের লাইসেন্স বাতিল করা, ইত্যাদি।
একটি রাষ্ট্র যা করতে নিষেধ করে ও সেই কাজ যদি কেউ করে অথবা রাষ্ট্র যা করতে আদেশ করে সেই কাজ যদি কেউ করে তবে তা রাষ্ট্রের উপর আঘাতের শামিল হয়। রাষ্ট্র যদি এই অনিয়মের কোনরুপ শাস্তির বিধান না করে তবে রাষ্ট্রে তুমুল বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতার সৃষ্টি হবে যা রাষ্ট্রের জন্য অমঙ্গলজনক তাই যে কোন অনিয়ম বা আইন ভঙ্গের জন্য অবশ্যই শাস্তির বিধান রাখা জরুরী।
শাস্তির উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে অপরাধ বিজ্ঞানীরা শাস্তিকে ৪ প্রকারে বিভক্ত করেছেন।
শাস্তির প্রকারভেদ ৪ টি হলো-
- দৃষ্টান্তমুলক,
- প্রতিশোধমুলক,
- প্রতিরোধমুলক,
- সংশোধোনমুলক।
দৃষ্টান্তমুলক শাস্তিঃ
দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির উদ্দেশ্য হলো, শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা বা উদাহরণের মাধ্যমে অপরাধীকে ও জনগণকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করা। অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয় যেন সে শাস্তির ভয়ে অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত থাকে। মানুষের মধ্যেই অপরাধ প্রবণতা আছে। কিন্তু যখন একজন অপরাধী শাস্তি পাবে তখন সেই শাস্তির কথা শুনে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে পরবে এবং যারা অপরাধ করার উদ্যোগ করতেছিলেন তারা অপরাধ করা থেকে হয়তবা নিবৃত্ত হবেন। মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে অপরাধের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পদ সে ভগ করতে পারবে না, সরকার বাজেয়াপ্ত করবে তখন তার আর অপরাধ করার আকর্ষণ থাকবে না। তাই আমরা বলতে পারি যে, দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি শুধু অপরাধীকেই নয় অপরাধকেও নিবৃত্ত করে।
প্রতিশোধমুলক শাস্তিঃ
প্রতিশোধমুলক শাস্তি মতবাদটি সার্বজনীন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের শাস্তি প্রচলিত। আগে প্রতিশোধমুলক শাস্তিতে ‘চোখের বদলে চোখ’, ‘দাতের বদলে দাত’, ‘জীবনের বদলে জীবন’ ইত্যাদি শাস্তি প্রচলিত ছিল। যে ব্যাক্তি কোন অপরাধ করেন, তিনি অনিষ্ট করেন সমাজের তথা দেশের। অপরাধী অপরাধ করবে, আর রাষ্ট্র তা নীরবে মেনে নেবে, তা হয়না, হওয়া উচিত নয়। কোন অপরাধীকে অপরাধ করতে দেখলে একজন শান্ত নাগরিকের মনও দোলায়িত হয়, তিনিও ঐ অপরাধীকে আঘাত করতে চান। কারন তার মন এই অপরাধের প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু তিনি যদি তা করেন তাহলে সেটাও অপরাধ হয়ে যাবে। তাই রাষ্ট্রই তার কোন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা কোন অপরাধের প্রতিশোধ নিতে চায় শাস্তির মাধ্যমে। আর এটাই হলো প্রতিশোধমুলক শাস্তি। পৃথিবীর ধর্মশাস্ত্রগুলোতেও প্রতিশোধের বিধান আছে।
প্রতিরোধমুলক শাস্তিঃ
শাস্তির প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রতিরোধ। যিনি অপরাধ করেছেন, তিনি যাতে আর কোনভাবেই অপরাধ করতে না পারেন, এই ধরনের শাস্তির মাধ্যমে সেতাই নিশ্চিত করা হয়। যেমন, কোন মানুষ হত্যাকারীকে ফাসি দিলে তিনি আর কোন ভাবেই মানুষ হত্যা করতে পারবেন না অথবা কোন ডাকাতকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলে সে আর কোন ভাবেই ডাকাতি করার সুযোগ পাবে না।
সংশোধনমুলক শাস্তিঃ
সংশোধনমুলক শাস্তির প্রধান উদ্দেশ্য হলো অপরাধীকে সংশোধন করা। অপরাধবিজ্ঞানীরা শাস্তির এই পদ্ধতিকেই সবচেয়ে আধুনিক মনে করেন। এই থিওরির জনক বলা হয় ‘লমব্রোসো’ কে। এই থিওরি মোতাবেক, অপরাধকে রোগ ও অপরাধীকে রোগী বা অসুস্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এই থিওরি অনুসারে, অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে তাকে সঠিক যত্ন যেমন- শিক্ষা, মানসিক সহায়তা ইত্যাদির মাধ্যমে সুস্থ বা সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত আলচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে,শাস্তির প্রকারভেদ ৪ টি ও শাস্তির উদ্দেশ্য হলো সনাজ বা রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দূরীকরন। এ জন্য আমরা দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি, প্রতিরোধমুলক শাস্তি, প্রতিশোধমুলক শাস্তি বা সংশোধনমুলক শাস্তি ব্যাবহার করতে পারি। তবে আমার মতে সংশোধনমুলক শাস্তিই হলো সবচেয়ে সঠিক ও কার্যকরি শাস্তি। কারন কোন মানুষই অপরাধী হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম গ্রহন করে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ইত্যাদি একজন মানুষ কে ধীরে ধীরে অপরাধী করে তোলে। আর এ জন্য আমরাই তথা সমাজ ও রাষ্ট্রই দায়ী। এর দায়ভার আমরা কোন ভাবেই এড়াতে পারি না। এজন্য সংশোধনমুলক শাস্তি ব্যাবহার করে তাকে সংশোধন করতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে যে সে অপরাধ করেছে। আর ঐ ব্যাক্তি যাতে আর কোন অপরাধ করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যাবস্থা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
লেখকঃ মোঃ ফয়জুল হাসান (শাওন), শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, আইন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ,ই-মেইলঃ hassan.foyzul@gmail.com
Discussion about this post