নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা তৃতীয়বারের মতো যে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেখানে নানা আঙ্গিকে রয়েছে চমক। নতুন মন্ত্রিসভায় দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি থাকছে নতুন মুখ। তাই নতুন মন্ত্রিসভায় পুরনোদের বেশির ভাগই থাকছেন না।
বর্তমান মন্ত্রিসভার হেভিওয়েট মন্ত্রীদের প্রায় কারোর ঠাঁই হবে না নতুন মন্ত্রিসভায়। এমনকি মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বাইরে মহাজোটের অন্য কোনো দলের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না।
রোববার বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি কে কোন দফতর পাচ্ছেন তাও জানান।
৪৬ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী থাকছেন।
৪৬ জনের মধ্যে ৩১ জনই নতুন। ২৪ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১২ জন নতুন, ১৯ প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে ১৬ জন এবং তিন উপমন্ত্রীই নতুন। তবে এর মধ্যে ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভায় থাকা চারজন রয়েছেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভার ১৫ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর স্থান হচ্ছে নতুন মন্ত্রিসভায়। এর মধ্যে পাঁচজন পদোন্নতি পেয়ে প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী হচ্ছেন।
সর্বশেষ (বর্তমান) মন্ত্রিসভা ৫২ সদস্য বিশিষ্ট। এতে ৩৩ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুইজন উপমন্ত্রী রয়েছেন। এই মন্ত্রিসভার মাত্র ১৫ জন সদস্য নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন। এর মধ্যে ১২ জন মন্ত্রী ও তিনজন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভার ৩৭ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর ঠাঁই হচ্ছে না নতুন মন্ত্রিসভায়। এরই মধ্যে নতুন মন্ত্রিসভায় যারা জায়গা পেতে যাচ্ছেন তাদের শপথগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ হবে। সেখানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শপথ পড়াবেন। এরপর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি। শপথের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দফতর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
নতুনদের মধ্যে কে কোন দফতর পাচ্ছেন
মন্ত্রিসভায় ডাক পাওয়া নতুন মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন- আবদুল মোমেন (পররাষ্ট্র), টিপু মুনশি (বাণিজ্য), নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন (শিল্প) , নুরুল ইসলাম সুজন (রেলপথ), শ ম রেজাউল করিম (গৃহায়ণ ও গণপূর্ত), গোলাম দস্তগীর গাজী (বস্ত্র ও পাট), শাহাব উদ্দিন (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন), সাধনচন্দ্র মজুমদার (খাদ্য), মো. তাজুল ইসলাম (স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়), দীপু মনি (শিক্ষা), মো. আব্দুর রাজ্জাক (কৃষি) ও মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (তথ্য)।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (নৌপরিবহন), জাহিদ ফারুক (পানিসম্পদ), ফরহাদ হোসেন (জনপ্রশাসন), ইমরান আহমদ (প্রবাসীকল্যাণ), জাহিদ আহসান রাসেল (যুব ও ক্রীড়া), আশরাফ আলী খান খসরু (মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ), মাহবুব আলী (বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন), মুরাদ হাসান (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ), স্বপন ভট্টাচার্য (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়), জাকির হোসেন (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা), কামাল আহমেদ মজুমদার (শিল্প), মুন্নুজান সুফিয়ান (শ্রম ও কর্মসংস্থান), কে এম খালিদ (সংস্কৃতিবিষয়ক), মো. এনামুর রহমান (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ) এবং শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (ধর্মবিষয়ক)।
উপমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন এনামুল হক শামীম (পানিসম্পদ), হাবিবুন নাহার (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন), মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (শিক্ষা)।
জায়গা হয়নি হেভিওয়েটসহ ৩৭ জনের
পুরনো মন্ত্রিসভার ৩৭ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বাদ পড়েছেন। বাদ পড়াদের অনেকেই নানা কারণে সমালোচিত ছিলেন।
বাদ পড়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন- অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পরিবেশ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, মৎস্যমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক (চুন্নু), বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষাবিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীও বাদ পড়েছেন।
এ ছাড়া বাদ পড়েছেন দুই উপমন্ত্রী পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আরিফ খান জয়।
পুরনো ১৫ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যে যেখানে
নতুন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হচ্ছে পুরনো মাত্র ১৫ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর। প্রায় সবাই আগের দফতরেই নিয়োগ পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন আগে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও এখন পদোন্নতি দিয়ে মন্ত্রী হচ্ছেন।
আগের মতোই আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ওবায়দুল কাদের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আনিসুল হক আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন।
আ হ ম মুস্তফা কামাল আগের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলেও নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি পাচ্ছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব।
অপরদিকে এম এ মান্নান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, নুরুজ্জামান আহমেদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বীর বাহাদুর উ শৈ সিং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সাইফুজ্জামান চৌধুরী ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হচ্ছেন। তারা বর্তমানে এসব মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আগের মতোই বিশিষ্ট সাহিত্যিক শওকত ওসমানের সন্তান স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন। যদিও নির্বাচনকালীন সরকারের সময় কিছুদিনের জন্য তাদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া আগের স্থানেই প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে নসরুল হামিদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মো. শাহরিয়ার আলম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে জুনাইদ আহমেদ পলক।
ছয় মন্ত্রণালয়-বিভাগের দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রী
নতুন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে থাকছে ছয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে।
টেকনোক্র্যাট কোটায় দুই মন্ত্রী, এক প্রতিমন্ত্রী
নতুন মন্ত্রিসভায় তিনজন টেকনোক্র্যাট সদস্য থাকবেন। তাদের মধ্যে দুইজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী।
স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং মোস্তাফা জব্বার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন। তারা বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন, তবে ভোটের আগে তাদের বাদ দেয়া হয়।
এ ছাড়া ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তারা পান ২৮৮ আসন। অন্যদিকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তাদের জোট পায় মাত্র সাতটি আসন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এমপিরা ছাড়া গত বৃহস্পতিবার নবনির্বাচিত এমপিরা শপথ নেন। জয়ের পর টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট, টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন শেখ হাসিনা।
সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রিসভায় একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্ধারণ করবেন, সেভাবে অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
তবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংখ্যার কমপক্ষে ১০ ভাগের ৯ ভাগ সংসদ-সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ পাবেন। সর্বোচ্চ ১০ ভাগের এক ভাগ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য মনোনীত (টেকনোক্র্যাট) হতে পারবেন বলে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিলে তারাই হবে দেশের নতুন সরকার। শপথ নেয়া পর্যন্ত আগের বর্তমান মন্ত্রিসভা বহাল থাকবে। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিলে আগের মন্ত্রিসভা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
Discussion about this post