কারো স্বীকৃতি বা স্বীকারোক্তি কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ নয়, কিন্তু সেটা estoppel বা প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশঃ-
ইংরেজি estoppel শব্দটি মূলত ফরাসি শব্দ ‘estoupail’ বা ‘estoup’ থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে- ‘shut the mouth’ ইংলিশ কোর্টে সর্বপ্রথম Estoppel নীতিটি প্রয়োগ করা হয় ১৮৭৭ সালে Hughes V. Metropolitan Railway Co. মামলায়। এবং ইন্ডিয়ান কোর্টে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৮৮০ সালে ‘Sourujmull And ors. V. The Ganges Manufacturing Co.’ মামলায়।Estoppel নীতিটি সম্পর্কে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ধারা ১১৫, ১১৬ এবং ১১৭ তে আলোচনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কিত আলোচনা Transfer of Property Act এর ধারা ৪৩ এ পাওয়া যায়।
Estoppel কি?
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১১৫নং ধারা মতে, যখন কোন ব্যক্তি তার কথা, কাজ বা ঘোষণার দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু বিশ্বাস করায় এবং ঐ বিশ্বাসের ফলে ঐ লোকটি কোন কাজ করে, তাহলে ১ম ব্যক্তি তার কথা, কাজ বা ঘোষণা থেকে পরবর্তীতে সরে যেতে পারবে না।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কোনো মামলায় অভিযুক্ত ‘ক’ চুরির কথা স্বীকার করে নিয়েছে। পরবর্তীতে সে যদি সেটি অস্বীকার করে, তাহলে বাধাপ্রাপ্ত হবে। (অর্থাৎ তাকে অস্বীকার করতে দেয়া হবে না বা তার কথাটি গ্রহণ করা হবে না) এটাই মূলত estoppel।
Estoppel নীতিটির ব্যাখ্যাঃ-
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারার নীতিটি হচ্ছে একটি সরল এবং ন্যায়পরায়ণ মতবাদ যা বর্ণনা করে যে, যদি কোন ব্যক্তি অপর একজন ব্যক্তির ঘোষণা, কাজ বা বর্জনের উপর ভিত্তি করে নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু করে বা অবস্থান পরিবর্তন করে। তাহলে তাদের দুপক্ষের মধ্যে মামলা চলাকালে অপরপক্ষ তার ঘোষণা, কাজ বা বর্জনের সত্যতা অস্বীকার করতে পারবে না।
প্রতিবন্ধক নীতির উপাদানসমূহঃ-
প্রতিবন্ধক নীতিটি কার্যকর করতে হলে, নিন্মলিখিত উপাদানসমূহ থাকতে হবে; যথাঃ-
• প্রতিবন্ধ যার বিরুদ্ধে কার্যকরী করতে ইচ্ছুক, সে ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যপক্ষকে কিছু করতে প্রভাবিত করেছিলেন।
• অন্যপক্ষ উক্ত ঘোষণা, কার্য বা নীরবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
• দ্বিতীয় পক্ষ এরূপ কার্যে প্রভাবিত হয়ে পূ্র্ব অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কিছু কাজ করেছিলেন।
• দ্বিতীয় ব্যক্তি বা প্রতিনিধির নিকট এই ঘোষণা, কার্য বা নীরবতা আইন ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে করা হয়েছিল।
• প্রতিবন্ধ অবশ্যই স্পষ্ট হতে হবে।
• পরবর্তীতে ঘোষণাকারী ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি এমন কোন দাবী উত্থাপন বা প্রমাণের চেষ্টা করলেন, যা পূর্ববর্তী ঘোষণার পরিপন্থী।
শর্তসমূহঃ-
• ঘোষণা, কার্য বা নীরবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অপরপক্ষকে কোন কার্য সম্পাদন করতে হবে এবং এই বিবৃতি প্রতারণামূলক হতে হবে।
• বিবৃতিটি যার প্রতি নির্দেশ করে করা হয়েছে, তার দ্বারাই কার্য সম্পাদিত হতে হবে। অন্য কেউ এর দ্বারা প্রভাবিত হলে চলবে না।
• বিবৃতিটি existing fact বা বাস্তব কিছু সম্পর্কে হতে হবে। অস্তিত্বহীন কোন কিছুর ক্ষেত্রে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
• বিবৃতিটিকে অবশ্যই স্পষ্ট এবং জড়তামুক্ত হতে হবে।
• আইনকে প্রতিবন্ধ নসাৎ করতে পারে না। অতএব, আইন সম্পর্কিত প্রতিবন্ধ গ্রহণযোগ্য নয়।
Estoppel নীতিটি যেসব ক্ষেত্রে কার্যকর হয় নাঃ-
১. যদি উভয়পক্ষ পূর্ব থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত থাকে।
২. এই নীতি কখনো আইনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয় না।
৩. যখন একপক্ষ ultra virus কাজ করে৷ অর্থাৎ তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোন কাজ করে, তখন এই নীতিটি প্রয়োগ করা যায় না।
Estoppel নীতির প্রকারভেদঃ-
Estoppel এর অনেক ধরণ বা প্রকার থাকলে, মূলত সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী এই মতবাদকে তিনটি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়; যথাঃ-
1. Estoppel by record- এই মতবাদটি কোন যোগ্যতাসম্পন্ন আদালতের রায় হতেই উৎপত্তি হয়। [S:115]
2. Estoppel by deed- এই মতবাদটি চুক্তি ব্যতীত অন্য কিছু হতে উত্থাপিত হয়ে থাকে। [S: 116]
3. Estoppel by pais বা conduct।। এই মতবাদটি দলিল বহির্ভূত কোন বিষয় হতে উত্থাপিত হয়ে থাকে। [S: 115, 117]
এছাড়াও Equitable estoppel, estoppel by negligence, estoppel on benami transaction, estoppel on a point of law এই প্রকারগুলোও পাওয়া যায়।
Waiver কি?
কোন চুক্তির এক পক্ষ তার আচরণের মাধ্যমে অপরপক্ষকে এ বিশ্বাস দিতে পারে যে চুক্তি সৃষ্ট কোন অধিকার তিনি বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে দাবী করা হবে না। তার এরূপ আচরণে আশ্বস্ত হয়ে অপর পক্ষ যদি কিছু করে, তাহলে পরবর্তীতে এরূপ বিশ্বাস তৈরি করা পক্ষ অধিকারটি নতুন করে দাবি করতে পারবে না, কারণ তা ন্যায়পর হবে না। যেমন- কোন মামলার বাদী সম্পত্তির কিছু অংশ বিষয়ে দাবী পরিত্যাগ করা কারণে এবং তা কার্যকর হওয়ার কারণে তারা ঐ সম্পত্তির বিষয়ে আপসকারী বিবাদীদের সাথে নতুন করে দাবি উত্থাপন বাধাগ্রস্ত হবে।।
তবে, এই নীতি দ্বারা কোনো পক্ষকে বারিত করতে হলে এটা অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে অপর পক্ষ তার প্রতিপক্ষের সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন উপস্থাপনের কারণে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে এবং সে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অপর পক্ষ তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যদি দেখা যায় যে, কোন পক্ষের আচরণটি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হয় তাহলে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নাও করতে পারে।।
যেমন- এক মামলায় বাধ্যতামূলকভাবে পেনশনের সুবিধা গ্রহণ প্রতিবন্ধক হিসাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
কেন আইনের বিরুদ্ধে এস্টোপেল কার্যকর হয় না?
Estoppel নীতিটি আইনের বিরুদ্ধে কার্যকর হয় না। মূলত আইনের বিরুদ্ধে কার্যকর না হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, Government of Bangladesh V. Dr. Md Nazrul Islam Bhuiyan (civil) 66 DLR (AD)255 মামলায় আইন লঙ্ঘন করে যখন ৬০ ফিটের ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। তখন আদালত সে অনুমোদনটি অকার্যকর এবং বাতিল করেন।”আইন সকলেই জানে”-এটা স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া হয়। তাই আইনের অজ্ঞতার কারণে অন্যের কথায় বিপদে পড়লে প্রতিবন্ধ মতবাদ কার্যকর বা প্রয়োগ করা যায় না। যেমন, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক পরিচয় দিয়ে ঋণ করলে, পাওনাদার পরে টাকা দাবি করলে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকটি নিজের বয়সের অজুহাত তুলতে পারে এবং বলতে পারে আইনত চুক্তি মূলে তার ঋণ করার সুযোগ ছিল না৷ সুতরাং আইন লঙ্ঘনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এমন কোন বিষয়ে প্রতিবন্ধ নীতির প্রয়োগ হবে না।
‘Jenendra Ch. Majumdar vs Dhirendra ch. Saha 8 DLR 170 মামলায় বলা হয়, যখন আদালতের নজরে কোন আইনের বিধান আনা হয়, তখন আদালত সেই বিধান অনুসারে কাজ করতে বাধ্য।
Feeding the Estopple বলতে কি বোঝায়?
‘8 PLC (Dac) 659’ মামলায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন কোন ব্যক্তি প্রতারণামূলকভাবে বা ভুলভাবে এমন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যার উপর তার কোন স্বার্থ বা স্বত্ত্ব নেই। এক্ষেত্রে যদি উক্ত বিক্রেতা বা হস্তান্তরকারী পরবর্তীতে উক্ত সম্পত্তিতে কোন স্বার্থ অর্জন করে তা feeding the estopple নীতি অনুসারে হস্তান্তর গ্রহীতার বা ক্রেতার অনুকূলে যাবে।
এই নীতির মূল কথা, স্বকার্যজনিত বাধার দ্বারা অশুদ্ধ হস্তান্তর সিদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো মূল্য গ্রহণপূর্বক যার সে মালিক নয় তা হস্তান্তর করে এবং পরবর্তীতে সে তাতে স্বত্ব অর্জন করে, তবে ঐ বিষয়ের গ্রহীতা পূর্বোক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক নীতি উত্থাপন করতে পারবে।
চুক্তিগত প্রতিবন্ধক বা ভাড়াটিয়ার প্রতিবন্ধক বা Estoppel by deed:-
এ সম্পর্কিত আলোচনা সাক্ষ্য আইনের ১১৬ধারায় করা হয়েছে। মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে চুক্তি হয় তা তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে। এটা Estoppel by deed হিসেবেও পরিচিত। যে ব্যক্তি কোনো দলিল সম্পাদন করে সে আদালতে দলিলের বিষয়ে ভিন্ন দাবি আনতে পারে না। এর ফলে দলিলের বিষয় অস্বীকার করা যায় না। ধারা ১১৬তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন চুক্তির মাধ্যমে অন্যের অস্থাবর সম্পত্তিতে দখল লাভ করে, তখন সে বা তার মাধ্যমে দাবিদার কেউ মালিক ও ভাড়াটিয়ার সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে যত ত্রুটিপূর্ণই থাকুক না কোনো মালিকের স্বত্ব অস্বীকার করার অনুমতি পাবে না।
অর্থাৎ ভাড়াটিয়া সম্পত্তিতে স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, তাকে যার নিকট থেকে সম্পত্তির দখল গ্রহণ করেছে প্রথমে তার নিকট ঐ সম্পত্তির দখল প্রত্যার্পণ করতে হবে।
Estoppel সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী এবং উত্তরঃ-
• প্রশ্নঃ- এস্টোপেল নীতি উত্তরাধিকারীদের উপর বাধ্য কি না?
উঃ- Bazlur Rahman vs Sadu Mia 45DLR 391 মামলায় বলা হয়, এটা উত্তরাধিকারীদের উপরও বাধ্যকর। বাদী তার বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তির অধিকার দাবী করেছে। যদি বাদীর বাবা সম্পত্তিতে বিবাদীর ভাড়াটিয়া স্বত্ব গ্রহণ বা স্বীকার করে থাকে তাহলে বাদীর বাবা বিবাদীর উক্ত স্বত্ব চ্যালেঞ্জ করতে প্রতিবন্ধক নীতি দ্বারা বাধাগ্রস্ত হত এবং বাদী নিজেও প্রতিবন্ধক নীতি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কেননা, প্রতিবন্ধক নীতি উত্তরাধিকারীদেরও বাধ্য করে।
• প্রশ্নঃ- আদালতের সিদ্ধান্ত স্বকার্যজনিত বাধা হিসেবে কি গণ্য হয়?
উঃ- “গোলাম মোরশেদ বনাম ফরহাদ জাহান, 42 DLR 223” মামলায় আদালত বলেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক দরখাস্তকারীর রিট মামলায় প্রদত্ত সিদ্ধান্ত আপিলে বাতিল না হয়ে বহাল আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা উভয়পক্ষের উপর বাধ্যকর। নালিশি সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি মর্মে সরকারের দাবী দরখাস্তকারী অস্বীকার করা থেকে উক্ত সিদ্ধান্তের স্বকার্যজনিত বাধা দোষে বারীত বটে।
• প্রশ্নঃ- বিধিবদ্ধ আইনের বিধান ভঙ্গ করে কোন কাজ করা হলে আইনভঙ্গকারী কি আইনের বিধানের বিরুদ্ধে স্বকার্যজনিত বাধা প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করতে পারে?
উঃ- “মাটিরা বেওয়া বনাম সুধীর চন্দ্র সাহা, 35 DLR 56” মামলায় আদলত সিদ্ধান্ত দেন যে, যেক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনের বিরুদ্ধে স্বকার্যজনিত বাধা প্রয়োগ করা হলে বিধিবদ্ধ আইন যে জননীতির ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে তা ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনের বিরুদ্ধে স্বকার্যজনিত বাধা প্রয়োগ করা যায় না। কিন্তু বর্তমান মামলায় স্বকার্যজনিত বাধা প্রয়োগ করা হলে জননীতি ব্যর্থ হওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। সেজন্যে বাদি স্বেচ্ছায় আইন ভঙ্গ করে নালিশি জমি বন্দোবস্ত দেয়ায় সে ঐ আইনের সুযোগ গ্রহণ করে বন্দোবস্ত দেয়া আইনত বাতিল ও পণ্ড ছিল দাবি করতে পারে না। এক্ষেত্রে বাদির দাবী স্বকার্যজনিত বাধা দোষে বারিত।
Discussion about this post